No one here gets out alive


Saturday, March 27, 2010

এ জার্নি বাই বোট

মেয়েটার বয়স এগারো। ওর ছোট ছোট দুটো ভাই। আট আর দুই বছরের। তিনজনেই গুটিসুটি মেরে নৌকার পাটাতনের নীচে শুয়ে আছে। বাবা নিশ্চুপ। মা অল্প অল্প কাপছেন। একটু আগেই মিলিটারিদের একটা লঞ্চ ওদের পাশ কাটিয়ে গেছে- মাঝি বুদ্ধি করে নৌকাটা এই সরু খালের মধ্যে ঢুকিয়ে না দিলে পাঁচ সদস্যের এই পরিবার, জনাদশেক নানা বয়সী নারীপুরুষ আর মাঝিটার হয়তো অন্যরকম একটা পরিণতি হতো। হয়তো কিছুই হতো না, হয়তো খানিক্ষন আগে দেখা ভেসে যাওয়া লাশগুলোর মত হতো।
সবচে' ছোট বাচ্চাটা আবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো। বোন তাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে- কিন্তু খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কিন্তু কাঁদতে কাদতে একসমময় ঘুমিয়ে পড়লো বাচ্চাটা। রাত নেমে এলো। নীকষ অন্ধকার একটা রাত। একটা কুপি জ্বলছে- কিন্তু মাঝি প্রস্তুত যেকোন সময় সেটা নিভিয়ে দেবার জন্যে।

ভোরের ঠিক আগে হঠাৎ চাপা কান্নার শব্দ। সবচে ছোট বাচ্চাটাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাথে সাথে কয়েকজন পানিতে নেমে পড়লো। কিন্তু এই জমাট অন্ধকারে কি আর করা সম্ভব?

সকাল বেলা আবার নৌকা ছাড়লো। অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে।

আপনার সাথে আমার কখনো দেখা হয় নি। কোন ছবিও নেই আপনার। বেঁচে থাকলে আপনার বয়স হতো বেয়াল্লিশ। দেখতে কেমন হতেন আপনি? বড় মামার মতো মোটা, কালো হাসিখুশি? প্রিন্টিং কালির ব্যবসা করতেন? মেজোমামার মতো সুদর্শন আর আড্ডাবাজ? ছাতে কবুতর পুষতেন? ছোট মামার মতো দুরন্ত, প্রেমিক আর ক্রিকেটার? প্রচন্ডরকমের দুষ্ট দুটো বাচ্চা কি আপনার থাকতো- যারা এসে আমার প্রায় কুড়ি বছর ধরে যত্ন করে রাখা ট্রান্সফর্মারের খেলনাটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিতো? আপনি কি আমাকে প্রতি শুক্রবারে নূরানিতে লাচ্ছি খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে যেতেন? সংক্রান্তিতে ঘুড্ডি ওড়ানো? দেখাতেন কি যে টিউবলাইটের টুকরো হামানদিস্তায় ভেঙ্গে কি সুন্দর ধারালো মিহি মাঞ্জা তৈরী করা যায়? কাঁধে চড়িয়ে ওয়াইজঘাটে স্টিমার দেখতে নিয়ে যেতেন? নিয়ে যেতেন আর্মেনিয়া্নদের চার্চটা দেখাতে? স্টেডিয়ামে খেলা? আপনি কি জানেন বাবুবাজারে এখন একটা ব্রীজ আছে?

আমি জানি না।

শুধু এইটুকু জানি যে সেই অন্ধকার রাতের থেকে আমরা আর বের হতে পারিনি। পুরনো দিনের অনেক গল্পই হয়- সত্তুরের ঝড়ে হাজি ইউসুফের লঞ্চডুবির গল্প- তারপরে বাহাত্তরে নয়াবাজারে প্রেস চালু করা। উনিশশো একাত্তর কে খুব যত্নের সাথে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। পুরনো ঢাকার সরু গলির সেই বাড়িতে সেই আশ্চর্য সময়গুলো নিয়ে কোন কথা আজও হয় না। সেই সময়গুলো নিয়ে লেখা কোন বই পড়া হয় না, সেই সময়গুলো নিয়ে বানানো কোন নাটক দেখা হয় না।

কারণ মনে হয় সেই গন্তব্যহীন অনন্ত নৌযাত্রা এখনো শেষ হয়নি।

No comments:

Post a Comment